শনিবার, ২ মে, ২০০৯

সাম্য

ভূমিকা

আমাদের এই কাহিনীর ঘটনাস্থল মধ্য কলকাতার শতাধিকবর্ষ পুরনো জরাজীর্ণ একটি শরিকী বাড়ি ৷ ঠিকানা ধরা যাক, ১৬/২/৪ খাঁদু মল্লিক লেন ৷ ১৬/২/৪ না লিখে ৩২ লিখলে হয়ত স্থান সংকুলান হত, কিন্তু কর্পোরেশনের নম্বরে বোধকরি ভগ্নাংশের নিয়ম চলে না বলে পুরো সংখ্যাটাই আলকাতরা দিয়ে বাড়ির নোনা ধরা দেওয়ালে লেখা আছে,  ওপরে ঘুঁটের প্রলেপ না পড়লে পড়তে বড় একটা অসুবিধে হয় না ৷

খাঁদু মল্লিক ইংরেজ আমলে প্রাতঃস্মরণীয় না হলেও, ভোজনস্মরণীয় ব্যক্তি ছিলেন,  অর্থা লোকে দুবেলা তাঁর মুণ্ডপাত না করে পাত পাড়ত না ৷ তিনি দানবীর পুরুষ ছিলেন, বহু লোককে বংশদান করে অগাধ সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন ৷ এ বাড়িটি তাঁরই বসতবাড়ি ৷ একসময়ে এখানে দরদালান, চণ্ডীমণ্ডপ, জুড়িগাড়ি., ঝাড়লণ্ঠন সবই ছিল, কিন্তু কালের প্রভাবে, এবং  খাঁদু মল্লিকের করিৎকর্মা বাংশধরদের কল্যাণে সে সব এখন উধাও হয়ে গেছে ৷ খাঁদু মল্লিকের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয়পক্ষ রূপ চারাগাছেরা এযাবৎ বিশাল বট অশ্বত্থে পরিণত হয়ে তাদের শাখাপ্রশাখা দিয়ে বাড়িটিকে নানা ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে ফেলেছে,  এবং বাড়ির যত্রতত্র  দেওয়াল, পাঁচিল আর ছাদ তুলে  সেটিকে একটি বৃহৎ মৌচাকের মত বানিয়ে ফেলেছে ৷ অন্ধকার সেই গোলকধাঁধায় পাকা গাইড না নিয়ে ঢুকলে হপ্তা খানেক পথ হারিয়ে ঘুরে মরতে হতে পারে ৷

 

বাড়ির বাইরে একপাশের দেওয়াল বরাবর একটা লম্বা টানা রোয়াক ৷ রোয়াকের একমাথায় ওপরে ওঠার দু-তিন ধাপ সিঁড়ি , আর তার ঠিক উল্টোদিকে, অর্থাৎ  রোয়াকের অন্যপ্রান্তে একখানা দরজা ৷ এই দরজা দিয়ে ঢুকলে ভেতরে একখানা ছোট ঘর, তার চেয়েও ছোট কলতলা এবং একচিলতে রান্নাঘর ৷ এসব খাঁদু মল্লিকের আমলে ছিল না, তাঁরই বংশের কেরাণীকুলতিলক কোন কৃতি পুরুষ এ অবদান রেখে গেছেন ৷ আমাদের কাহিনী যখন শুরু, তখন আইনের কোন অজ্ঞাত প্যাঁচের ফলে এই ক্ষুদ্র সম্পত্তিটুকু মল্লিক বৃক্ষের দুই উপশাখার প্রান্তের দুই লতাতুতো ভাইয়ের অধিকারে এল ৷ তাদের নাম ধরা যাক নাদুগোপাল আর যাদুগোপাল ৷ দুজনেরই বয়স পঁচিশের কাছাকাছি, দুজনেরই নিকট আত্মীয় বলতে কেউ নেই, এবং দুজনে একই কলেজের ছাত্র ৷ তফাতের মধ্যে যাদুগোপাল ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় বার চারেক গোঁত্তা খেয়ে বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ইদানিং দুনিয়ার শোষিত মানুষের স্বার্থে মন প্রাণ নিয়োজিত করেছে ৷ অন্যদিকে নাদুগোপাল কোনরকমে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে পরীক্ষার বেড়া টপকে শিক্ষিত বেকারের দলে নাম লিখিয়েছে, এবং চাকরির সম্ভাবনা না দেখে অন্য প্রকারে রোজগারের চেষ্টায় আছে ৷  

 

তবে যাদুগোপাল আর নাদুগোপাল মল্লিক বংশের একটা পুরনো ঐতিহ্যে ছেদ টানল ৷ তারা ঠিক করল সম্পত্তিটুকু আর ভাগ না করে দুজনে একসঙ্গেই থাকবে ৷

 

৷৷ ১ ৷৷

যাদুগোপাল আর নাদুগোপাল ঘরটিতে আস্তানা গাড়ার দু তিন দিনের মধ্যেই মশার জ্বালায়  অস্থির হয়ে উঠল ৷ ঘরে জানলা নেই,  একটি মাত্র দরজা, প্রায় লখীন্দরের বাসর ঘর বললেই চলে, কিন্তু তবু রাত হলেই কোথা থেকে হাজারে হাজারে মশা এসে উপস্থিত হয় ৷ মশার কামড়ে দুজনেরই রাতের ঘুম মাথায় উঠল ৷ তিনচারদিন এই উপদ্রব সহ্য করে শেষে নাদুগোপাল কার থেকে চেয়েচিন্তে কার থেকে একখানা মশারি যোগাড় করে আনল ৷ কিন্তু সে রাত্রে সে যখন নিজের বিছানায় মশারিখানা টাঙাতে গেল, যাদুগোপাল তাকে বাধা দিল ৷

-উঁহু, মশারি খাটাতে পারবে না ৷

অবাক হল নাদুগোপাল,

-কিন্তু কেন ?

-কেন না আমার কাছে মশারি নেই ৷

আরো অবাক হল নাদুগোপাল,

-তোমার কাছে মশারি নেই বলে আমি মশারি খাটাতে পারব না কেন ?

বিরক্তির আওয়াজ করল যাদুগোপাল,

-এই সোজা ব্যাপারটা বুঝতে পারলে না ? ঘরে যত মশা আছে সেগুলো এখনো দুভাগে ভাগ হয় ৷ অর্ধেক তোমাকে কামড়ায় আর অর্ধেক আমাকে ৷ তুমি মশারি টাঙালে সব মশাগুলো আমাকেই কামড়াবে ৷ এই সামাজিক অবিচার আমি মেনে নিতে পারি না ৷

সামজিক সাম্যের এই ব্যাখায় নাদুগোপালের মুখে আর কোন কথা এল না, সে চুপচাপ মশারি না খাটিয়েই শুয়ে পড়ল ৷    

৷৷ ২ ৷৷

পৈতৃক একটা আঙটি ছিল, হাজারদুয়েক টাকায় সেটা বেচে নাদুগোপাল একখানা ব্ল্যাকবোর্ড,  একটা ছোট ডেস্ক আর খানদুয়েক সতরঞ্চি কিনে একটা কোচিং স্কুলে খুলে ফেলল ৷ সতরঞ্চিতে সকালে পড়ুয়ারা বসে, আর রাত্রে সে দুটো বিছানা পাতার কাছে আসে ৷ নাদুগোপাল শুধু নয়, যাদুগোপালও তাতে শোয়, যাতে সামাজিক সাম্য অক্ষুণ্ণ থাকে ৷

পাড়ার মোড়েই একটা সরকারি স্কুল, কিন্তু ধারে কাছে অন্য কোন কোচিং ক্লাস নেই ৷ সুতরাং নাদুগোপালের ছত্র মন্দ জুটল না ৷ তাছাড়া সে পড়ায়ও ভাল, সুতরাং দিনে দিনে  তার কোচিং স্কুলের শ্রীবৃদ্ধি হতে লাগল ৷

মাসতিনেক  বাদে, যখন নাদুগোপালের কোচিং স্কুলের ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে,  একদিন যাদুগোপাল তাদেরই  বয়সী একটি ছেলেকে সঙ্গে করে নাদুগোপালের কাছে  হাজির হল ৷

-       নাদু একে তোমার কোচিং স্কুলে চাকরি দিতে হবে ৷

আকাশ থেকে পড়ল নাদুগোপাল,

-       ওকে ! ওতো পেটো পদু, ইস্কুলে পড়াশোনা করত না, ক্লাস কেটে সিনেমা দেখত ৷ তার জন্যে হেডমাস্টারের কাছে কতবার মারও  খেয়েছে ৷ ওতো ক্লাস সেভেনে অবধি পড়েছে, ক্লস টেনের ছেলেদের পড়াবে কি করে ?

বিরক্ত হল যাদুগোপাল

-       কি করে পড়াবে সেটা তুমি শিখিয়ে নাও ! মায়ের পেট থেকে পড়ে সবাই সব কিছু শিখে ফেলে নাকি ? একজন নিপীড়িত মেহনতি মানুষের স্বার্থে এটুকু তো তোমায় করতেই হবে ৷

বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে গেল নাদুগোপালের,

-       পুঁজিপতি ! আমি পুঁজিপতি হলাম কি করে ? পুঁজিপতিদের কাছে তো লাখ লাখ টাকা থাকে ৷ আমি তো মোটে হাজারদুয়েক টাকা খরচা করে কোচিং ইস্কুল খুলেছি ৷ তাছাড়া  ওই বা নিপীড়িত মেহনতি মানুষ হল কি করে ? ওর বাবার তো পার্কের ধারে দোতলা বাড়ি আছে ৷

 

আরো বিরক্ত হল যাদুগোপাল,

-       তুমি দেখছি একটা আস্ত গবেট ! লাখটাকা থাকলেই পুঁজিপতি হয় তোমায় কে বলল ? পুঁজি পুঁজিই , তা সে দুলাখটাকাই হোক আর দুহাজার টাকাই  হোক ৷ আর বাবার তো দোতলা বাড়ি থাকলেই যে সে নিপীড়িত মেহনতি মানুষ হয় না সে কথাই বা তোমায় কে বলল ? ইস্কুলে যে ওর ওপর নিপীড়িন হত তা তো তুমি নিজেই বললে ৷ আর তাছাড়া গতবার ভোটের সময়ে আমাদের পার্টিকে জেতানোর জন্যে ও যে কি মেহনত করেছে, তা কি তোমার জানা আছে ?

অতএব পেটো পদু নাদুগোপালের সহকারী শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হল ৷ কিন্তু তার বিদ্যের যা দৌড় তাতে সে পড়ানো আরম্ভ করলে, ছাত্রদের হৃদয়ে  জ্ঞানের আলো না জ্বলে কোচিং স্কুলের লালবাতি জ্বলার সম্ভাবনাই প্রবল ৷ সুতরাং নাদুগোপাল তাকে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে  না পড়িয়েই শুধু মাইনে নেবার সুযোগ করে দিল, যাতে সে পাড়ার ঠেকে বসে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রাম করে যেতে পারে ৷  

৷৷৩ ৷৷

মাসছয়েক কেটে গেছে, তিনচরদিন টানা ছুটি থাকায় নাদুগোপাল কলকাতার বাইরে বেড়াতে গিয়েছিল৷ ফিরে এসে দেখল তাদের ঘরে ঢোকার রোয়াকটার ভোল পাল্টে গেছে ৷ রোয়াকের ওপর প্লাস্টিকের শিট আর বাঁশ দিয়ে তৈরি গোটা কতক দোকান উঠে গেছে ৷ দোকানের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকে দরদাম করছে ৷

যাদুগোপাল রাস্তাতেই দাঁড়িয়েছিল, তাকে দেখে নাদুগোপাল আর্তনাদ করে উঠল,

-       এসব আবার কি ?

-       কেন ?  তোমার আবার অসুবিধে কি হল ? বঞ্চিত মানুষদের কর্মসংস্থানের জন্যে আমাদের এটুকুতো করতেই হবে ৷

যাদুগোপাল অসুবিধে হবে না বলে অভয় দিলেও, অল্পদিনের মধ্যেই বিলক্ষণ অসুবিধে হতে আরম্ভ করল ৷ সরু রোয়াক, তার আর্দ্ধেকটা জুড়ে সামনের দিকে  দোকান, বাকি আর্দ্ধেকটায় দোকানদারদের মালপত্র ঠাসা, কোচিং স্কুলে ঢোকার পথ প্রায় বন্ধ ৷ তারওপর  দুএকবার জিনিষপত্রে পা লাগা নিয়ে ছাত্রদের মা বাবাদের সঙ্গে দোকানদারদের তুমুল ঝগড়া হয়ে গেল ৷ নাদুগোপালের কোচিং স্কুলে ধীরে ধীরে ছাত্রসংখ্যা কমতে লাগল ৷

এর ধাক্কাতেই নাদুগোপাল নাজেহাল হয়ে পড়েছে, এমন সময়ে আর এক নতুন বিপত্তির উদয় হল ৷ সেলস ট্যাক্স অফিস থেকে এক ট্যাক্সবাবু এসে হম্বিতম্বি আরম্ভ করে দিলেন ৷

-       আই ! ব্যবসা করলে সেলস ট্যাক্স সার্ভিস ট্যাক্স দিতে হয় জানেন না ? সেলস ট্যাক্স রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন ?

না ৷ নাদুগোপাল সার্ভিস ট্যাক্স কাকে বলে জানে না ৷ রেজিস্ট্রেশন কাকে বলে তাও তার জানা নেই ৷ সুতরাং মোটা টাকার একটা ট্যাক্স নোটিশ ধরিয়ে দিয়ে ট্যাক্সবাবু বিদায় নিতে উদ্যত হলেন ৷ ভয়ে ভয়ে  নাদুগোপাল শুধু জিজ্ঞেস করল,

-       ওদের থেকে ট্যাক্স নেবেন না ?

ট্যাক্সবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল,

-       কাদের থেকে ?

-       ওই যে, রোয়াকে যারা দোকান দিয়েছে ?

-       ওরা কি ওই রোয়াকের মালিক ?

-       না ৷

-       ওরা কি ওই রোয়াকের ভাড়াটে ?

-       আজ্ঞে না ৷

-       ওদের কি কোন স্থায়ী ঠিকানা আছে ?

-       বোধহয় না ৷

-       তবে আমাদের খাতায় ওদের কোন অস্তিত্ব নেই ৷ যাদের অস্তিত্বই নেই তার ট্যাক্স কি করে দেবে ? যাকগে, অনেক বাজে বকিয়েছেন, এবার সময় মতন ট্যাক্স দিয়ে দেবেন, নইলে বিপদে পড়বেন ৷

শদুয়েক টাকা পথ খরচা নিয়ে ট্যাক্সবাবু বিদায় নিলেন ৷ নাদুগোপাল অতি সুবোধ বালকের মতন কয়েকদিনের মধ্যেই দুপকেট ঝেড়ে ট্যাক্স মিটিয়ে দিল ৷

এরপর দ্বিতীয় আর এক বিপত্তির আবির্ভাব হল ৷  মাসের শেষে ইলেকট্রিক বিল এলে, তার অঙ্কটা দেখে নাদুগোপাল আঁতকে উঠল ৷ কয়েকদিন ধরে সে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল,  বিলের ধাক্কায় এবার তার নাভিশ্বাস উঠে এল ৷ এদিক ওদিক খানিক খোঁজ করে তার বুঝতে বাকি রইল না যে রোয়াকের দোকানের আলোর রোশনাইয়ের  জোগাড় তার ইলেকট্রিক লাইন থেকেই হয় ৷ যাদুগোপালের সঙ্গে কথা বলে এও বোঝা গেল যে এ ব্যাপারে তার প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে ৷ সামাজিক সাম্যের প্রতি নাদুগোপালের মত পুঁজিপতিদের এটাই নাকি নৈতিক দায়িত্ব ৷

নাদুগোপাল আর কোন তাত্ত্বিক তর্কের মধ্যে গেল না ৷ শুধু  পরের মাসের পয়লা তারিখে দেখা গেল, যে সে তার জুতো, জামা, বিছানা, বালিশ সমেত অন্তর্ধান করেছে ৷ তার ছাত্রদের থেকে খবর পাওয়া গেল যে সে নাকি কোচিং ইস্কুল  তুলে দিয়ে কলকাতা ছেড়ে পুনা চলে গেছে ৷ আর তার কয়েকদিন বাদে এও বোঝা গেল যে সে ইলেকট্রিক বিলের টাকাটা মেটায় নি ৷ যাদুগোপাল  এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হল, এবং নাদুগোপাল যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একজন চর, কিম্বা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার একজন দালাল, সে বিষয়ে তার কোন সন্দেহই রইল না ৷ পারলে সে হয়ত নাদুগোপালের কালো হাত ভেঙে কিম্বা গুঁড়িয়ে দিত, কিন্তু পুনার টিকিট ভাড়া জোগাড় না করতে পারায় সেটা আর হয়ে উঠল না ৷

 

উপসংহার

উপসংহারে বিশেষ কিছু বলার নেই ৷ নাদুগোপালের কলকাতার কোচিং স্কুল সংহার হয়ে গেলেও,  এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে পুনায় তার ব্যাবসা ভালই চলছে ৷ এন.জি.র কোচিং পুনার লোক একডাকে চেনে ৷ কোচিং ইস্কুলের রোজগারে সে একটা সে একটা সেকেণ্ড হ্যাণ্ড মারুতি গাড়ি কিনেছে, এবং ঘরে ঘরণী আনার চেষ্টায় আছে ৷

বিলের টাকা না মেটানোয় নাদুগোপাল এবং যাদুগোপালের্ ঘরের লাইন ইলেকট্রিক কোম্পানী কেটে দিয়েছে ৷ তাতে দোকানের রোশনাই এবং খদ্দের দুইই অনেক কমে গেছে ৷ বিনা পরিশ্রমের চাকরিটি চলে গিয়ে ইদানীং  পেটো পদুরও  সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মোকাবিলায় কিঞ্চিত ভাঁটা পড়েছে ৷

নাদুগোপাল চলে যাওয়াতে সব মশার কামড় এখন যাদুগোপালকেই এখন একা খেতে হচ্ছে৷ ৷ তাতে সামাজিক ন্যায়ের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে কিনা সেটা অবশ্য সেই বলতে পারে ৷ প্রয়োজন থাকলে ১৬/২/৪ খাঁদু মল্লিক লেনে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে আসতে পারেন ৷     

রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০০৯

নৃতত্ত্ব

এ লেখাটা ঠিক আমার বলা চলে না৷ কারণ আমি এটা বৈজ্ঞানিক বুধোবাবুর গবেষণার খাতা থেকে প্রায় হুবহু টুকে দিয়েছি৷ কেবল বুধোবাবুর অত্যাধুনিক যুক্তাক্ষর মুক্ত বানানগুলো পাল্টে একালকার মতো করে নিয়েছি৷ শুধু যুক্তাক্ষর নয়, ভাষার অন্যান্য ব্যাপারেও বুধোবাবু কম করে পাঁচশো বছর এগিয়েছিলেন, তিনটের বদলে একটা স, দুটোর বদলে একটা র দিয়ে কাজ চালিয়ে গেছেন৷ সেগুলোও বাধ্য হয়ে পাল্টাতে হয়েছে৷ নাহলে বুধোবাবুর ভাষায়, ‘সুনদোর সিসুদের সোনধেবেলা বারিতে বসে পরাসোনা করা উচিত’ লিখলে আপনাদের পরতে, সরি, পড়তে অসুবিধে হত৷

মৃত্যুর আগে বুধোবাবু তাঁর টাকাপয়্সা সব বঙ্গীয় পশু সেবা সমিতিকে দান করে গেছেন, তা দিয়ে তাঁর বাড়িতে বৃদ্ধ ছাগলদের জন্য আশ্রম হবে৷ কেবল স্নেহবশতঃ তাঁর সারাজীবনের গবেষণার ফসল তাঁর নোটবইখানা আমাকে দিয়ে বলে গেছেন কিস্তিতে কিস্তিতে তার থেকে লেখা ছাপাতে৷ নোটবইয়ের লেখা পড়ে কারোর জ্ঞানলাভ হলে তাকে আর বৃদ্ধবয়সে তাঁর ওই আশ্রমের দ্বারস্থ হতে হবে না, তাঁর এইরকম আশা ছিল৷

আমাদের পাড়ার অনেকে অবশ্য বুধোবাবুকে বৈজ্ঞানিক বলে মানতে রাজি নয়৷ তারা বলে বুধোবাবু নাকি ইস্কুলের বেড়া পর্যন্ত পেরোননি, আর তাছাড়া বুক অবধি দাড়ি, ডাঁটি ভাঙা চশমা, তালি দেওয়া ড্রেসিং গাউন আর ছেঁড়া জুতো থাকলেই যদি বৈজ্ঞানিক হওয়া যেত, তাহলে ওইরকম বৈজ্ঞানিক পাগলা গারদে খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে৷

আমি অবশ্য এইসব যুক্তি মানতে রাজি নই৷ ভারতবর্ষে পুরাকালে অনেক মুনি ঋষি জন্মেছেন, তাঁদের আমরা এখনো শ্রদ্ধা করে থাকি, কিন্তু তাঁরা সব মাধ্যমিক পাস করেছিলেন, এমন কথা কোন ইতিহাস বইতে লেখে না৷ তাছাড়া বৈজ্ঞানিকদের যে স্যুটের বিজ্ঞাপনের মত সাজগোজ করতে হবে, তারই বা কি মানে আছে ? নিন্দুকের কথায় কান দিয়ে কাজ নেই, বরং নোটবইয়ের লেখার কথায় আসি৷

বুধোবাবু বহুমুখী প্রতিভা ছিলেন, সমস্ত বিষয়ে তাঁর অবাধ গতি ছিল, লেখেননি এমন বিষয়বস্তু নেই৷ প্রথম লেখাটা নৃতত্ত্বের ওপর৷ নিচে দিলাম, পড়ে আপনারাই বিচার করুন, বুধোবাবু বৈজ্ঞানিক ছিলেন কি ছিলেন না৷
বুধোবাবুর লেখা --

আদিতে যখন বানর সবে মন্যুষত্ব পেয়ে দুপায়ে দাঁড়াতে শিখছে, তখন সেই অর্দ্ধমানবের্ নাম ছিল হোমো ইরেক্টাস৷ এই হোমো ইরেক্টাস আজকের সভ্য মানুষ হয়ে ওঠা অবধি নানা প্রজাতির মধ্য দিয়ে তার বিবর্তন হয়েছে৷ সেই সব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, তাদের মানসিক গঠনের ছাপ আমাদের সমাজের মধ্যে এখনো রয়ে গেছে৷

মানুষ প্রথমে শিকার করে খেত৷ আগে শিকারের মাথায় ধাঁই করে একঘা মুগুরের বাড়ি বসিয়ে দিলো৷ তারপর সেটাকে ঠ্যাঙ ধরে টানতে টানতে আস্তানায় নিয়ে গিয়ে তার ছালটা ছাড়িয়ে লুঙ্গি বানালো, আর মাংসটা কাঠের জ্বালে তন্দুরি করে গুষ্টিশুদ্ধু খেলো৷ হোমো ইরেক্টাসের বংশধর এই প্রজাতির নাম আমরা রাখতে পারি হোমো মাংসখাস৷

শিকার করতে গেলে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করতে হয়, তারওপর আবার শিকার না পাওয়া গেলে মাঝেমধ্যে উপোসও করতে হয়৷ কাঁহাতক আর ঝক্কি সয়? তাই কিছু মানুষ চাষ করতে শিখলো৷ মাটিতে বীজ পুঁতে জল দাও, আর নেচেকুঁদে বেড়াও৷ ক্রমে মাটি ফুঁড়ে গাছ বেরোবে, সেই গাছে ফল হলে তখন পোয়াবারো, আর কষ্ট করে শিকার করতে হবে না, ঘরে বসে বসে খাবে৷ এই প্রজাতিকে আমরা বলতে পারি হোমো চাষবাস৷

এই দুই প্রজাতি আজকাল সশরীরে পাওয়া না গেলেও, তাদের মানসিকতা আজও সভ্যমানুষের মধ্যে বর্তমান৷ আমাদের সমাজে হোমো চাষবাস আর হোমো মাংসখাস দুইই আছে৷ হোমো চাষবাসের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অল্প অল্প করে উপার্জন করে, আর হোমো মাংসখাসেরা তাতে ভাগ বসায়৷ তাদের জীবন দর্শন হলো, কে আর অত খেটেখুটে রোজগার করে? তার চাইতে বরং লাগাও হালুম করে থাবা৷ যেমন ধরুন নুটুবাবুর কথা৷ ভদ্রলোক ছাপোষা মধ্যবিত্ত হোমো চাষবাস, সারাজীবন শরীকি বাড়িতে অনেক কষ্ট করে কাটিয়েছেন৷ অল্প মাইনের চাকরিতে যা পেতেন, একটু একটু করে জমিয়ে একটা ছোট জমি কিনেছিলেন, আশা ছিল শেষ বয়সে একটা ছোট দোতলা বাড়ি করে তার বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়বেন৷

অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নুটুবাবু একদিন জমিটা দেখতে গেছেন, একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক দুজন ছোকরাকে সঙ্গে করে এসে হাজির হলেন৷
- কি দাদা, এখানে বাড়ি করবেন নাকি?
জমির গর্বে একগাল হেসে নুটুবাবু বললেন,
- হ্যাঁ, এই একটা ছোটখাট দোতলা-
- বাঃ! বাঃ! ভদ্রলোক নুটুবাবুকে উত্সাহ দিলেন – আপনি বাড়ি করবেন জেনে বড় ভাল লাগল৷ আপনাকে দেখেই বোঝা যায় আপনি একজন সজ্জন মানুষ৷ আমাদের পাড়ায় আপনার মতো লোকই তো চাই৷ কিছু দরকার হলে আমাদের বলবেন৷ আমার নাম ভুঁদো দত্ত৷

নুটুবাবু চিরকাল শরীকি বাড়ির অশান্তির মধ্যে কাটিয়ে এসেছেন, এরকম সহৃদয়তায় তাঁর হাসিটা আরো দুইঞ্চি চওড়া হয়ে গেল,
- থ্যাঙ্ক ইউ,থ্যাঙ্ক ইউ, আপনার মতো প্রতিবেশী পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের কথা৷
- আরে ছি ছি, একি বলছেন – লাজুক লাজুক হাসি হাসলেন ভুঁদোবাবু – প্রতিবেশীই তো প্রতিবেশীর জন্যে করে৷ আমরা আপনার জন্যে করবো, আপনি আমাদের জন্যে করবেন, এই আদানপ্রদান নিয়েই তো সমাজ৷ তা আপনি আমাদের একটা অনুরোধ নিশ্চই রাখবেন?

খুব উত্সাহের সঙ্গে নুটুবাবু বললেন,
- হ্যাঁ, নিশ্চই, নিশ্চই৷ বলুন কি করতে হবে?
- এই বেশী কিছু না, আমাদের একটা ছোট ক্লাব আছে, তার জন্যে একটা টিভি কিনে দিতে হবে৷

নুটুবাবুর হাসিটা শুকিয়ে একেবারে বাসি কিসমিসের মত হয়ে গেল৷
- য়্যাঁ! তার মানে?
- হ্যাঁ, ওই ফুটবলের বিশ্বকাপ আসছে না? তা একা একা বাড়িতে বসে কি খেলা এনজয় করা যায়? একটা টিভি হলে আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে ক্লাবে বসে দেখব৷ আপনিও দেখবেন৷
- তার জন্যে আমাকে টিভি কিনে দিতে হবে ? আর্তনাদ করে উঠলেন নুটুবাবু৷
- আরে না না ! আশ্বস্ত করলেন ভুঁদোবাবু- আপনার এই বয়সে কি আমরা আপনাকে ঘাড়ে করে টিভি কিনে এনে দিতে বলতে পারি? আমাদের এই লাখখানেক টাকা দিলে আমরাই কিনে এনে লাগিয়ে নেব৷ আপনাকে শুধু শুধু কষ্ট্ করতে হবে না৷
- একলা-খ টাকা! মনে হলো নুটুবাবুর নাভিশ্বাস উঠছে৷
- বাঃ! অবাক হলেন ভুঁদোবাবু- একলাখ টাকা না হলে বড়সড় প্লাজমা টিভি হবে কি করে? সবাই মিলে বসে দেখবে না? তাছাড়া পাড়ার একটা ইজ্জত আছে না?
- কিন্তু আমি কি করে একলাখ টাকা দেব?
- দেখুন, চালাকি করবেন না – বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন ভুঁদোবাবু – এতটাকা দিয়ে জমি কিনতে পারেন, দোতলা বাড়ি করতে পারেন, আর সমাজ কল্যাণের জন্যে একলাখ টাকা দিতে পারবেন না?
- সমাজ কল্যাণ! নুটুবাবুর প্রায় গঙ্গাযাত্রায়্ যাবার মতন অবস্থা৷
- হ্যাঁ, সমাজ কল্যাণ৷ এত আশ্চর্য হবার কি আছে? আমরা কি সমাজের অঙ্গ নই? তাছাড়া এই কাগা বগা – দুই সঙ্গীর দিকে চোখ তুলে ইশারা করলেন ভুঁদোবাবু- এরা চুপচাপ বসে টিভি দেখলে সমাজের কত কল্যাণ জানেন? নাহলে কোথায় গিয়ে পেটো মারবে, কিম্বা কার মেয়েকে তুলে আনবে, কিম্বা আপনার মতো লোকের ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেবে তার ঠিক আছে?

ভুঁদোবাবুর মত হোমো মাংসখাসের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সহজ নয়, সুতরাং ক্লাবের টিভি কিনে দিয়ে নুটুবাবু সমাজসেবায় হাতেখড়ি করলেন৷ তাতেও অবশ্য হলো না৷ বাড়ি করতে গিয়ে ভুঁদোবাবুর থেকে বাড়ি তৈরির মালমশলা কিনে পাড়ার বেকার ছেলেদের উপকার করতে হলো৷ সেই মাল-মশলার গুণে বাড়ির এমন সুন্দর ত্রিভঙ্গ চেহারা দাঁড়াল, যে পিসার টাওয়ার লজ্জা পাবে৷ তারপর দুর্গাপূজো, কালীপূজো, সরস্বতীপূজো, ঘেঁটুপূজো, সঙ্গীত অনুষ্ঠান, এসবের নামে নিত্য নতুন নজরানা দিয়ে নুটুবাবু তাঁর সামাজিক কর্তব্য বজায় রাখলেন, আর ভুঁদোবাবু তারই দৌলতে দুচারটে মিনিবাস কিনে ফেলে পাড়ার মধ্যমণি হয়ে রইলেন৷

হোমো মাংসখাসেরা আগেকার দিনে রাজা বাদশা হত, এখন নেতা হয়৷ তাছাড়া পুলিশ, সরকারী দপ্তর, রেলের অফিসেও প্রচুর হোমো মাংসখাস পাওয়া যায়৷

হোমো মাংসখাসদেরই একটা শ্রেণী আছে, যাদের আমরা বলতে পারি হোমো কাঁঠালভেঙেখাস৷ এরা অতটা হিংস্র নয়, মাথায় হাত বুলিয়ে কার্যসিদ্ধি করে৷ যেমন আমাদের খাঁদুবাবু৷
একদিন গজেনবাবু বাসস্টপে দাঁড়িযে ঘনঘন ঘড়ি দেখছেন, প্রায় পৌনে নটা বাজল, অথচ বাসের দেখা নেই, আজ লেটমার্ক থেকে আর বাঁচা গেল না৷ এমন সময হাসিহাসি মুখে খাঁদুবাবুর উদয় হল৷
- কি গজেনবাবু, আজ এত দেরি যে?
- আর বলবেন না দাদা, সকালে কলে জল ছিল না, বেরোতে দেরি হয়ে গেল৷ তারপরে এদিকে আবার বাস নেই৷
- তাতে কি হয়েছে? অভয় দিলেন খাঁদুবাবু – আপনার অফিস তো ডালহৌসীতে? আমাকে ওখানে একটা কাজে যেতে হবে, চলুন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছি৷ এই ট্যাক্সি, ট্যাক্সি৷
ট্যাক্সির ফুরফুরে হাওয়া খেতে খেতে গজেনবাবু সবে বৌবাজার মোড় অবধি গেছেন, এমন সময়ে খাঁদুবাবু রোককে, রোককে বলে চেঁচিয়ে উঠলেন৷
আঁতকে উঠে গজেনবাবু বললেন, কি হলো খাঁদুবাবু?
- আর বলবেন না মশাই, মনের ভুলে দরকারি ফাইলটা বাড়িতে ফেলে চলে এসেছি৷ যাই আবার গিয়ে নিয়ে আসি৷

খাঁদুবাবু বৌবাজার মোড়ে নেমে গেলেন, আর গজেনবাবু ডালহৌসী পৌঁছে ট্যাক্সির ভাড়া মেটালেন৷

অবশ্য এটা প্রথম নয়৷ এর আগেও খাঁদুবাবু অনেককে ট্যাক্সি চড়িয়েছেন, হোটেলে খাইয়েছেন, বইমেলায় বেড়াতে নিয়ে গেছেন৷ একবার তো বগলাবাবুকে প্রায় সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বেড়িয়ে আনছিলেন, শেষ পর্যন্ত বগলাবাবুর মেয়ে জামাই দিল্লী থেকে এসে পড়ায় সেটা আর হয়ে ওঠে নি৷

হোমো কাঁঠালভেঙেখাসের আমাদের সমাজে কোন অভাব নেই, সর্বত্র পাওয়া যায়৷ অফিসে, কলেজে, পাড়ায়, সব জায়গাতেই এদের দেখা মেলে৷

হোমো কাঁঠালভেঙেখাসের স্বগোত্রীয় একটি প্রজাতি ছিল, হোমো ঘাড়েবসেখাস৷ এটি যৌথপরিবার ব্যবস্থা উঠে যাবার জন্যে প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে, তার আগে যে কোন বড় একান্নবর্তী পরিবারে এদের দু-একজনের দেখা হামেশাই মিলত৷ তবে ইদানীং অনেক পুত্রকন্যারা নিজেদের বৃদ্ধপিতামাতাকে এই প্রজাতি ভুক্ত জ্ঞান করেন, এবং তাঁদের ভরণপোষণের ব্যবস্থাও সেই অনুপাতে নিয়ন্ত্রিত করে ফেলেছেন৷

এইসব প্রধান প্রজাতি ছাড়াও আরো অনেক প্রজাতি আছে৷ তাছাড়া অনেক সময়ে এও দেখা গেছে বয়েস অনুযায়ী প্রজাতির পরিবর্তন হয়৷ যেমন অল্পবয়েসে বাঙালী ছেলেরা যে প্র্জাতির অন্তর্ভুক্ত থাকে, তার নাম হোমো বাজেবকেযাস৷ যে পাড়াতেই থাকুন না কেন, কোন জটলার পাশ দিয়ে গেলে তাদের এইধরণের মন্তব্য আপনি শুনতে পাবেন,
- আরে ভণ্ডুলকর যা খেলল না!
- আরে ওসব বলে কাজ নেই, এখানে ওসব কিছু হবে না৷ ওসব বিলেত আমেরিকায় হয়, আমাদের এখানে ওসব চলবে না৷
- আরো শোন আমি যা বলছি৷ আমার মেজ পিসীর ছোট দেওরের ভায়রাভায়ের জাড়তুতো ভায়ের ছেলে রাইটার্সে কাজ করে৷ তার কাছে খবর আছে ভবেশ ভড় এবারে নির্দলে দাঁড়াচ্ছে৷

এই সব হোমো বাজেবকেযাসদের যখন বয়স হয়, তখন তাদের অনেকেই হোমো সর্বদাহতাশে রূপান্তরিত হয়৷ তাদের তখন কথায় কথায় দীর্ঘশ্বাস পড়ে৷
- (দীর্ঘশ্বাস) আমাদের এ জীবনে আর কিছুই হল না মশাই৷
- (দীর্ঘশ্বাস) আমার বাবার পয়সাও ছিল না, সোর্সও ছিল না৷ তাই আর কিছুই করতে পারলাম না৷
- (দীর্ঘশ্বাস) আর চেষ্টা করে কি হবে? ওদের সব ভেতর থেকে ঠিক করা থাকে৷ শুধু শুধু এদ্দুর থেকে ঠেঙিয়ে যাও, তারপর হা-পিত্যেশ করে বসে থাকো৷ কি হবে গিয়ে!

তবে বাংলার পুরুষমানুষরা সাধারণতঃ হোমো ফাঁকামাঠেজিতেযাস প্রজাতির মধ্যে পড়েন৷ স্রেফ কপাল আর প্রতিপক্ষের অন্যায আচরণের জন্যেই যে এঁরা যে এক-একজন গুণবান, রূপবান, ধনবান গণ্যমান্য ব্যাক্তি হয়ে উঠতে পারেন নি, তা তাঁদের মুখ্ থেকে প্রায়শই শোনা যায়৷
- নেহাত বাঁ-কব্জিটা টনটন করছিল, না হলে দেখে নিতাম ব্যাটাকে৷
- আরে সেবারের অঙ্ক পেপারটা যদি শক্ত না হত, তাহলে আমার লাইফটাইতো অন্যরকম হতো৷ দেখতিস ফার্স্টক্লাস পেয়ে বিলেত্ চলে গিয়ে মার্সিডিজ গাড়ি চড়ছি৷
- ওঃ! ইন্টারভিউতে অতগুলো ছেলে না এলে চাকরিটাতো আমারই বাঁধা ছিল, এতদিনে দেখতেন প্লেনে চড়ে হিল্লীদিল্লী করছি৷

অন্যদিকে বঙ্গরমণীরা কিন্তু হোমো ভালকরেখাস শ্রেণীভুক্ত, বিশেষতঃ তাঁরা যদি মাতৃস্থানীয়া হন৷ তাঁদের মুখে সাধারণতঃ এই ধরণের কথাই লেগে থাকে,
- সেইতো কোন সকালে খেয়েছিস, তোকে আর দুটো ভাত দিই
- ওকিরে! শুধু ভাত খাচ্ছিস কেন? আর একটা মাছ নে৷
- শিগ্গির সব দুধটা খেয়ে নে, নাহলে মারব এক থাপ্পড়৷ বাঁদর কোথাকার!
- কিচ্ছু বেশি রুটি দিই নি৷ ওবাড়ির গুলু তোর থেকে চার বছরের ছোট, সেও তিনটে রুটি খায়, আর তুই খাবি না?

হোমো ভালকরেখাস ছাড়াও বঙ্গরমণীদের আর একটি প্রজাতি আছে, তাদের আমরা বলতে পারি হোমো দেখেশুনেযাস৷
- ভাল করে দুদিক তাকিয়ে রাস্তা পার হবি, যা জোর গাড়ি যায়!
- সুটকেশটা চোখে চোখে রাখবি, দিনকাল ভাল নয়৷ আর দেখিস, কোন অচেনা লোকের সঙ্গে ভাব জমাসনি যেন৷
- বেশি দেরি করিস নি যেন, সকাল সকাল ফিরে আসিস৷

এইসব প্রজাতি নিয়ে ব্যাপক ভাবে গবেষণা হওয়া উচিত৷ আমি নিজেও এই বিষয়ে ইউনিভার্সিটিতে থিসিস জমা দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম যে সেখানকার কর্তাব্যাক্তিরা সবাই হোমো মুখস্থবিদ্যেতেপাস প্রজাতির, তাঁরা এই মৌলিক চিন্তার কদর বুঝবেন না৷ সুতরাং নোটবুকে লিখে রাখলাম, ভবিষ্যতে কোন সুযোগ্য লোকের হাতে পড়লে কাজ হবে৷
বুধোবাবুর নৃতত্ত্ববিষয়ক রচনা এখানেই শেষ, আমার লেখাও৷ পাঠকের পছন্দ হয়ে থাকলে বুধোবাবুর নোটবই থেকে পরেরবার অন্য লেখা প্রকাশ করার ইচ্ছে রইল ৷

**(কারিয়া পিরেত ছদ্মনামে ফ্যান্টাসটিকে প্রথম প্রকাশিত)

শনিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০০৯

আমার কথা

আজকে দাদা যাবার আগে / বলব যা মোর চিত্তে লাগে / নাইবা তাহার মানে হোক / নাইবা বুঝুক বেবাক লোক ৷

লেখা মনের খাদ্য বটে, কিন্তু খারাপ লেখাকে অখাদ্য বলা যায় কি না তা ঠিক জানিনা৷ যদি বলা যেত, তাহলে হয়ত সমালোচকগণ আমার এযাবত্ প্রকাশিত লেখাগুলিকে অনায়াসে সেই আখ্যা দিতেন৷ রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনী যেমন মরিয়া প্রমাণ করেছিল যে সে মরে নাই, আমিও হয়তো সেইরকম লিখে প্রমাণ করছি যে আমি লিখতে পারি না৷ তা যাকগে৷ সম্পাদকের প্রমাদবশতঃই হোক, আর আমার কপালজোরেই হোক, লেখা যে কয়টা এদিকে সেদিকে বেরিয়েছে, সেগুলিকে ইন্টারনেটের ভুবনজোড়া জালে ফেলে আরো বেশী লোককে যন্ত্রণা দেবার আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ৷